পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়া ও বন্য পশুর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করা। তেমনি একটি ভূগর্ভস্থ মসজিদের নাম শাকপাক আতা মসজিদ।
শাকপাক আতা ভূগর্ভস্থ মসজিদ পশ্চিম কাজাখস্তানের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। ম্যাংগিস্তাউ অঞ্চলে অবস্থিত এই মসজিদ তাউ-চিক গ্রাম থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
উঙ্গাজি পর্বতমালা থেকে দুটি গিরিখাত যেখান থেকে সারিতাস উপসাগরের দিকে প্রসারিত হয়েছে, শাকপাক মসজিদটি ঠিক সেই মনোমুগ্ধকর স্থানে অবস্থিত। স্থাপত্যশৈলী ও ঐতিহাসিক মূল্য উভয় বিবেচনায় মসজিদটি অনন্য। স্থাপত্যশৈলীর বিচারে এটি একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। কেননা কঠিন শিলা খোদাই করে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে মসজিদ শাকপাক আতার সঙ্গে জড়িত হলেও এটি অসংখ্য বুজুর্গ ব্যক্তির স্মৃতিধন্য স্থান। মূল ব্যক্তি শাকপাক আতার জীবন ও ইতিহাস মানুষের কাছে এক রহস্যময় অধ্যায়। তার পরও শত বছর ধরে মানুষ এখানে আধ্যাত্মিক সৌরভ লাভ করতে উপস্থিত হয়। মসজিদের প্রতিটি কোণা, নকশা ও বৈশিষ্ট্য নথিভুক্ত করা সম্ভব হলেও শাকপাক আতার প্রকৃত নাম ও জীবনী সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব হয়নি, যা মসজিদ নিয়ে মানুষের কৌতূহল আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভূগর্ভস্থ মসজিদের পাশেই আছে ভূগর্ভস্থ কবরস্থান।
যেখানে হাজার বছর যাবৎ মানুষকে কবর দেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। তুর্কমেন, আদিজ উপজাতি ও অন্যান্য প্রাচীন উপজাতির লোকদের এখানে দাফন করা হয়েছে। একসময় মসজিদের সঙ্গে একটি মাদরাসাও ছিল। যেখানে শিক্ষার্থীরা দিনে শিক্ষা গ্রহণ করত এবং রাতে বিশ্রাম নিত। কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংঘাতের সময় শত্রুরা নামাজরত শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা করে। শহীদ শিক্ষার্থীদের দেহাবশেষ এখনো বিশেষ স্থানে সংরক্ষিত আছে। অবশ্য তাঁদের দেহাবশেষের উল্লেখযোগ্য অংশ মসজিদের কাছে দাফন করা হয়েছে।
এই অঞ্চলে সুফিদের আগমন ঘটে খ্রিস্টীয় নবম শতকে। তবে স্থানীয় উপজাতিরা এমন গুহায় বহু বছর আগ থেকে বসবাস করত। ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস, শাকপাক মসজিদ যে গুহায় অবস্থিত তাতে প্রস্তর যুগ থেকে মানুষের বসবাস ছিল। এই অঞ্চলের এমন গুহাগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে পানির ব্যবস্থা থাকা। ফলে এগুলো মানুষের আদর্শ বসতি বলেই বিবেচনা করা হতো। প্রাচীন যুগের লোকেরা প্রাকৃতিক পাহাড়ি গুহাকে বসবাসের জন্য প্রসারিত করেছিল এবং প্রাচীন চিত্রকলা দ্বারা সজ্জিত করেছিল। এই অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটার পর সুফিরা গুহাগুলোকে তাঁদের আধ্যাত্মিক সাধনার স্থান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এসব গুহায় অবস্থান করে তরুণ সুফিরা আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণও গ্রহণ করতেন।
সুফি সাধকরা কয়েক শতাব্দী যাবৎ শাকপাক ভূগর্ভস্থ মসজিদটি সংরক্ষণ করে আসছেন। তাঁরা মসজিদের প্রতিটি কোণকে তাঁদের স্মৃতিসম্ভারে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন। তাঁরা সুফি জীবনের নানা প্রতীক ও আল্লাহপ্রেমের কবিতা তাতে উত্কীর্ণ করেছেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো তাঁরা প্রাচীন দেয়ালচিত্রগুলো মুছে ফেলেননি, যদিও তা ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যার মধ্যে আছে ঘোড়া, আরোহী, ষাঁড়, হাত ও জটিল ফুলের নকশা। এসব দেয়ালচিত্র মূলত পূর্বে বসবাস করা বিভিন্ন উপজাতির প্রতীক।
শাকপাক ভূগর্ভস্থ মসজিদের মূল প্রার্থনাকক্ষ চারটি অলংকৃত স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। যার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি প্রসারিত গম্বুজ, যাতে স্থাপিত জানালা দিয়ে মসজিদে আলো প্রবেশ করে। মসজিদের ভেতর দিয়ে একটি সর্পিল সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে, যেখানে অনেক কবর আছে। কবরগুলো তুর্কমেন ও কাজাক বংশোদ্ভূতদের।
শাকপাক আতাকে নিয়ে কাজাক সমাজে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে, তাঁর প্রকৃত নাম ছিল শাহ মর্দান, যার অর্থ সর্পরাজ বা পাতালপুরের রাজা। ম্যাংগিস্তাউ অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন সর্পপূজার রীতির সঙ্গে এই কিংবদন্তির মিল রয়েছে। কারো মতে, শাকপাক আতার নামটি এসেছে যুদ্ধের ময়দানে তাঁর বীরত্বের কারণে। কেননা যুদ্ধের ময়দানে তাঁর তরবারি থেকে অগ্নস্ফূিলিঙ্গ ঠিকড়ে পড়ত, যাকে কাজাক ভাষা শাকপাক বলা হয়। কারো কারো মতে, তাঁর আস্তানার চারপাশের চকমকে পাথরের কারণে তাঁকে শাকপাক বলা হয়ে থাকে। তবে এর সবই প্রচলিত কথা মাত্র। তাঁর সম্পর্কে তথ্যনির্ভর কোনো সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না।
তথ্যঋণ : ইউরেশিয়া ডটট্রাভেল